শুরুর কবিতা

বেলা সোয়া ১১টা।

রিকশার টুং-টুং শব্দ পেলেই বই থেকে মুখ তুলে পাঁচিল-সংলগ্ন রাস্তার মোড়টার দিকে তাকাচ্ছি। এ রাস্তা কখনও ব্যস্ত থাকে না। আর এখন তো ঝুম বৃষ্টি- ঝুমঝুম শব্দ ছাপিয়ে রিকশার বেল সহজেই কানে পৌঁছচ্ছে। আমি কবিতার জন্য অপেক্ষা করছি। আর কবিতার বই পড়ছি। আমার এক হাতে নির্মলেন্দু গুণের কবিতার বই। আরেক হাতে চায়ের কাপ। চা-টা বেশি জঘন্য। আমি সাধারণত চা বানাই না। যখন বানাই, সেটা জঘন্য হওয়া বাধ্যতামূলক। চা আর সিগারেট- দুটোর জন্যই পাঁচিলের উলটো দিকে মতি মিয়ার চায়ের দোকান আমার ভরসা। তবে মতি মিয়ার মত কবিতারও চায়ের হাত ভালো। আমার ভাড়া পোড়াবাড়িতে সে যতবার এসেছে, ফ্লাস্কে চা বানিয়ে এনেছে।

বাড়িওয়ালার কাছে শুনেছি, ওই কোমরসমান পাঁচিলটার জন্মের সময় ভারতবর্ষ ভাগ হয়ে যায়। পাঁচিলটার ওপাশের রাস্তা দিয়ে ভাষা আন্দোলনের সময় টুকটাক মিছিল গেছে। বিহারির কোপে বাঙালির ছিটকে পড়া রক্ত-মগজও নাকি গায়ে মেখেছে পাঁচিলটা। এর মাঝে ঝরে গেছে কত ঝুমঝুম বৃষ্টি- তাতে ধুয়ে গেছে পাঁচিলটার যাবতীয় অস্বস্তি। তার গায়ে এখন সবুজ ছত্রাকদের সুখী সংসার। তার জুলজুলে হলুদ রঙ এখন খুব ভালো করে লক্ষ্য না করলে বোঝা যায় না।
আমি দেশলাইয়ে ফশশশ শব্দ তুলে সিগারেট ধরাই। ঝুম বৃষ্টিতে বারান্দায় এসে সিগারেট ধরানো আমার প্রিয় কাজ। বৃষ্টির ছাঁট মাখতে মাখতে নির্মলেন্দু পড়ি। উনি লিখেছেন: "আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে…"

টুং! রিকশা আসছে। কবিতা গলা পর্যন্ত প্লাস্টিকের পর্দা টেনে দিয়েছে।

আমার বাসার ঠিক নিচে রিকশা থামিয়ে গলা বাড়িয়ে ওপরে তাকালো কবিতা। চেঁচিয়ে ডাকলো- 'আবিইইর?' আমি আধাটানা সিগারেটটা চায়ের তলানীতে ফেলে বইটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালাম এবং শ্যাওলা-ধরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে এলাম। কবিতা এক হাতে শাড়ির আঁচলের কোণ দিয়ে চশমার কাঁচ মুছছে। আরেক হাতে গরম টিফিন ক্যারি। চশমা পরে সে আমাকে বললো, 'হাতে কী?'
-কবিতার বই।
কবিতা বিরক্ত চোখে তাকালো- 'তুমি বই হাতে নিয়ে বিয়ে করতে যাচ্ছ?'
-যাচ্ছি।
আমি হাসলাম। কবিতা সামনে তাকিয়ে বললো, 'ছোটবেলায় বাবা বলতো- আমার মেয়েকে রাজপুত্রের সাথে বিয়ে দেবো। এখন তার মেয়ে একটা গাধাকে বিয়ে করতে যাচ্ছে শুনলে খুব কষ্ট পাবে।'
আমি এবার শব্দ করে হাসলাম।

কবিতাকে 'হুমায়ুন আহমেদ টাইপ' সুন্দর লাগছে। চুল খুলে দিয়েছে সে, কপালে টিপ। চশমার কাঁচের ওপারে দেখা যাচ্ছে সে চোখে কাজলও দিয়েছে। কিন্তু নতুন বৌয়ের মত লাল শাড়ি পরেনি, তার শাড়ির রং আকাশি নীল।

ঝুম বৃষ্টির মধ্যে রিকশা কাজি অফিসের দিকে যাচ্ছে। এতদিন বর আসতো কনের বাড়িতে, আজ কনে বরকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে কাজি অফিসে নিয়ে যাচ্ছে।
বিয়েটা করে কবিতা সোজা আমার বাসায় এসে উঠবে মনে হচ্ছে। সাথে ব্যাগট্যাগ না থাকলেও টিফিন ক্যারি থেকে সুগন্ধ পাচ্ছি। শুধু ভুনা খিচুড়ি নিয়ে আসার মতো মেয়ে কবিতা না। বেগুন ভাজাও আছে সম্ভবত। চট করে দুটো ডিম ভেজে ফেললে খারাপ হয় না। আচ্ছা, বাসায় কি সরিষার তেল আর শুকনা মরিচ আছে?
আংটি দেওয়া হলো না কবিতাকে। একটা পেইন্টিং দেওয়া উচিত। ভাবছি বৃদ্ধ পাঁচিলটার ওপাশ থেকে কবিতার রিকশার মোড় নেয়ার মুহুর্তটা তেল-জলে এঁকে ফেলবো। আরও ভালো হয় যদি কবিতার বানানো চায়ে তুলি ডুবিয়ে ছবিটা আঁকা যায়। আজ থেকে শ’খানেক বছর পরে এই ছবির উদ্দেশ্য ও বিধেয় নিয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদদের কনফিউশনে ফেলা যাবে।

আমার এই কনফিউজ করাতেই আনন্দ।

কুকুর-বিড়াল বৃষ্টি হচ্ছে। রাস্তার পানিতে বিলি কেটে রিকশা এগোচ্ছে। নির্মলেন্দু গুণ বলছেন-
কাম-বাসনার সঙ্গী না হোক, কেউ অন্তত আমাকে
জিজ্ঞেস করুক: ‘তোমার চোখ এতো লাল কেন?'

৫ এপ্রিল ২০১৬
ঢাকা ১২২৯

মন্তব্যসমূহ